ড. মোঃ আবদুল মুঈদ
একবিংশ শতাব্দীর আজকে এই সময়ে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব সম্মুখীন এক ভয়াবহ অদৃশ্য শত্রæ কোভিড-১৯ নামক এক ভাইরাসজনিত রোগ করোনার প্রাদুর্ভাবে। সেই মহামারীর তান্ডব থেকে মুক্তি পায়নি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে দিনে দিনে মৃত্যুর মিছিল যখন বাড়ছে, ঠিক তখন এই রোগ হতে মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ঢালরূপে আবির্ভূত হয়েছে বাংলার কৃষি। সেই ঢাল হাতে নিপুণ সৈনিক বাংলার কৃষক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের সফল পরিচালক বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ত মন্ত্রণালয় কৃষি মন্ত্রণালয়, যার মূল চালিকা আসনে বসে আছেন এই কৃষি পরিবারেরই একজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক, এমপি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষিবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ “এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে” কে পালনের জন্য দেশের এই মহামারীতে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর পদক্ষেপগুলো রীতিমতো বিশ্ব নজির হিসেবে ইতোমধ্যেই সমাদৃত হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে খেটে খাওয়া, হতদরিদ্র ও ভাসমান মানুষেরা। এদের কথা মাথায় রেখে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। সারাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষদের ১০ টাকা কেজি দরে ৯০ হাজার টন চাল দেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবেলায় গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সারাদেশে অতিরিক্ত সাড়ে ৬ কোটি টাকা ও ১৩ হাজার টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। এসব চাল ও টাকা ত্রাণ হিসেবে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬৪ জেলায় ১২ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা এবং প্রায় ৪৬ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। সরকারি এই সমস্ত কার্যক্রমে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে করোনার বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় খাদ্য সংগ্রহের কাল হিসেবে পরিচিত বোরো মৌসুমের প্রায় শতভাগ ধান ইতোমধ্যেই কর্তন সম্পন্ন হয়েছে গোটা দেশজুড়ে। আসন্ন আমনের বীজতলা প্রস্তুতেও রয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। এরই মধ্যে “খড়ার উপর মড়ার ঘাঁ” হিসেবে হয়ে গেল কালবৈশাখী ঝড় আম্ফানের তাÐব। এই ঝড়ের তাÐবে বাংলাদেশের প্রধান ফল মৌসুমে যেসব ফল উৎপাদিত হয় যেমন আম, কাঁঠাল, লিচুসহ অন্যান্য ফলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমান এলাকাভিত্তিক ভিন্ন হলেও গড়ে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ আম ও লিচুর ফলন নষ্ট হছে। যেকোন দুর্যোগকালে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকাতে প্রয়োজন পুষ্টিকর খাদ্য। যে কোনো খাবার খেয়ে পেট ভরানো যায়, কিন্তু তাতে দেহের চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ঘাটতি পূরণ হলেও পুষ্টি সমস্যা অনেক বড় আকারে বিরাজিত রয়েছে। ফলে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পুষ্টিহীনতার কারণে নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে অহরহ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার পরিস্থিতিতে এ সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন।
২০১৮-১৯ সালের হিসাব মতে বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের আবাদ হয়েছিল, যার মধ্যে প্রধান ফল হিসেবে আম আবাদের জমি ছিল প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর আর উৎপাদন ছিল ২২ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন, কাঁঠাল আবাদ হয়েছিল ৭১ হাজার ছয়শত হেক্টর জমিতে যার ফলন ছিলো ১৮ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন, আর লিচু ছিলো ৩১ হাজার চারশত এর মতো, যার ফলন ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। এ বছর ২০১৯-২০ সালে সেই লক্ষমাত্রা বেড়ে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২২ লক্ষ ৩২ হাজার মে.টন। রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নাটোর, গাজীপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে অধিকাংশ আমের ফলন হয়। লিচুর আবাদ হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। অধিকাংশ লিচুর ফলন হয় রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা, গাজীপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলায়। কাঁঠালের আবাদ হয়েছে ৭১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ও সম্ভাব্য উৎপাদন ১৮ লাখ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন। টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও রাঙ্গামাটিতে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয়। অন্যদিকে, আনারসের আবাদ হয়েছে ২০ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে ও সম্ভাব্য উৎপাদন ৪ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। আনারসের সিংহভাগ উৎপাদন হয় টাঙ্গাইলে। চলতি বছর (২০১৯-২০) বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধিসহ উৎপাদন লক্ষমাত্রা অর্জনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট হর্টিকালচার উইং বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছেন।
করোনাকালীন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংএর বিভিন্ন ক্যাটাগরির মোট ৭৬টি হর্টিকালচার সেন্টারগুলো নিয়মিত গ্রাহকদের সেবা প্রদান করছেন করোনা যোদ্ধা হিসেবে। বার্ষিক কর্ম সম্পাদন ব্যবস্থাপনা বা এপিএর আওতায় সেন্টারগুলোর চারা উৎপাদনের লক্ষমাত্রা গেল বছরের তুলনায় ক্ষেত্র বিশেষে ২-৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ পেঁপে, আম, কুলসহ বিভিন্ন সবজি ও ফুলের চারা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যেই সেন্টারগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেন্টারগুলোতে প্রতিদিন সামজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত চারা-কলম বিক্রয় ও ফল উৎপাদনে চাষীদের বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
সমসাময়িককালে করোনাকালীন মহামারী ও আম্ফান ঝড়ের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পূরণে কৃষি মন্ত্রণালয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপটি নিয়েছে সেটি হলো,তার আওতাধীন সকল দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শক্রমে দশটি (১০) সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য পরিবহণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহনের অবাধে যাতায়াত নির্বিঘœ করা,পরিবহনের সময় যাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর মাধ্যমে কোন রূপ হয়রানির শিকার নাহয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বিআরটিসির ট্রাক ব্যবহারে উদ্যোগ গ্রহণ, স্থানীয়ভাবে ব্যাংকের লেনদেনের সময়সীমা বাড়ানো, পার্সেল ট্রেনে মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য পরিবহনের আওতা বাড়ানো, হিমায়িত ওয়াগন ব্যবহার করা যায় কিনা তা নির্ধারন, ফিরতি ট্রাকের বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল হ্রাস, ত্রাণ হিসেবে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নিকট অনুরোধ জানানো, অনলাইনে এবং ভ্যান যোগে ছোট ছোট পরিসরে কেনাবেচার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ, প্রাণ, একমি, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠান যারা কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ম্যাঙ্গোবার, আচার, চাটনি প্রভৃতি তৈরি করে, তাদেরকে এ বছর বেশি বেশি আম-লিচু কেনার অনুরোধ জানানো ও মৌসুমি ফলে যেন কেমিক্যাল ব্যবহার করা না হয় সেজন্য জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সমন্বিতভাবে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করাসহ আম্ফান ঝড়ে ঝরে পরা আমকে রক্ষা করতে স্টিীপিং পদ্ধতিতে কাঁচা আম সংরক্ষণ বিষয় সচেতনতা বৃদ্ধি ও এ সংক্রান্ত লিফলেট বিতরণ। সুপারিশগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পত্রজারিসহ আদেশ প্রদান সম্পন্ন করেছেন। আশা করা যায়, ধানের মতো আমাদের আরেক প্রধান কৃষি পণ্য মৌসুমি ফল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণেও কৃষি মন্ত্রণালয় সফল হবে।
আমাদের দেশের আবহাওয়া, মাটিও জলবায়ু যেমন-ফল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী, তেমনি বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩০ রকম ফলের এক বিশাল ভাÐার রয়েছে এই দেশে। এরমধ্যে প্রায় সত্তর রকমের বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের নিয়মিত আবাদ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ফল একটি অর্থকরী ফসল যা শুধু পুষ্টির চাহিদাই মেটায় না। এর পাশাপাশি ফল গাছ কাঠ দেয়, ছায়াদেয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। ফল ভেষজ বা ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থসবল জীবন লাভ করা যায়। বর্তমানে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের ১১৫-১২০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্যতা হলো মাত্র ৩৫-৪০ গ্রাম। বাংলাদেশে সারা বছরব্যাপী ফলদবৃক্ষ রোপণ করা যায়, তবুও জুন থেকে আগষ্ট মাস হচ্ছে বৃক্ষ রোপণের উপর্যুক্ত সময়। সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখে আম-লিচুসহ মৌসুমি ফল বিপণনে প্রস্তাবিত ১০ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন যাতে করে আম-লিচুসহ মৌসুমি ফলের সাথে সম্পৃক্ত চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদার এবং সংশ্লিষ্ট সকলেই উপকৃত হতে পারেন। য়
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ফোন: ৯১৪০৮৫০, ইমেইল- dg@dae.gov.bd